বাঙালির কারু ও লোকশিল্পের সংরক্ষিত তথ্যবলি

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে লোক ও কারুশিল্পের অবস্থান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক, কায়িক শ্রমে ও নান্দনিক কৌশলে ব্যবহারিক বস্তুকে সৌন্দর্য ও কারুমন্ডিত করার উদ্দেশ্য অলঙ্ককরণকেই আমরা ‘কারুশিল্প’ হিসেবে অভিহিত করি। অন্যদিকে যৌথ চেতনার ফসল হচ্ছে লোকশিল্প। যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহজ-সরল পরিবেশে তৈরি হয়। একজন প্রধান স্রষ্টার পরিবেশে তৈরি হয়। একজন প্রধান স্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম আরও কয়েকজনের স্পর্শে হয়ে ওঠে সর্বজনীন লোকশিল্প। গঠনশৈলী, বিষয়বস্তু, উৎপাদন ও নির্মাণ কৌশলে লোকজ রূপ থাকায় তা লোকশিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়। আর সুশৃঙ্খল সূত্রমাফিক তৈরি করা হলেও কারুশিল্পে থাকে ঐতিহ্যের সমাচার। এরপরও তা সৃজনশীলতা পাশাপাশি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের কারুশিল্প ও কারুশিল্পীদের অবদান অনস্বীকার্য। আবহমানকাল থেকেই এদেশের লোক ও কারুশিল্প নিজ নিজ ধারায় প্রবহমান।
লোক ও কারুশিল্পের মধ্যে বিশেষত পোড়া মাটির হাড়ি অথবা বুননের ক্ষেত্রে যদি চিন্তা করেন শতরঞ্জি, জামদানি শাড়ি এবং বেত কেন্দ্রিক যে শীতল পাটি, তার একটা স্বকীয়তা আছে৷ কাঁসা-পিতলেরও খ্যাতি আছে৷ ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল থেকে শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা-পিতল বললেও আলাদা একটা স্বকীয়তা আছে৷ এছাড়া দেশ-জাতির যে আবেগের কথা বলা হয়, নকশিকাঁথাই সেটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়৷
লোক ও কারুশিল্পের দু'টি দিকই মানুষের জীবনে প্রয়োজন বলে মানুষ এটা সৃষ্টি করেছে৷ তাঁরা তাঁদের ব্যক্তি জীবনে, ব্যবহারিক জীবনে বা নান্দনিকতার কারণে প্রাত্যহিক জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করেন৷ আপনি যদি আলপনার কথা বলেন, দেয়াল চিত্রের কথা বলেন, তাহলে হয়ত এগুলোর ব্যবহারিক উপযোগিতা সেভাবে নেই৷ কিন্তু মননের দিক থেকে, ভালোলাগার দিক থেকেও এগুলোর উপযোগিতা কম নয়৷ আর যদি সরাসরি ব্যবহারের কথা বলেন, তাহলে কারুশিল্পগুলো আমাদের ব্যবহারিক জীবনে অনেক বেশি কার্যকর এবং প্রয়োজনীয়৷ বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প বিশ্বখ্যাত৷ বিশেষ করে আপনি যদি মসলিনের কথা বা জামদানির কথা অথবা শীতল পাটির কথা বলেন, তাহলে দেখবেন এর একটা আলাদা স্বকীয়তা আছে, পরিচিতি আছে৷ আপনি হয়ত শুনেছেন, খুব সম্প্রতি শীতল পাটি ও জামদানিকে সাংস্কৃতিক ঐহিত্য হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে৷ আমি মনে করি, ইউনেস্কো যখন এই স্বীকৃতি দেয় তখন এগুলোর মর্যাদা অনেকগুণ বেড়ে যায়৷ এমন অনেক আরো শিল্প আমাদের আছে, যেগুলো ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে ঢুকতে পারে৷ তাই আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷
শীতলপাটি : বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এক শিল্পের নিদর্শন হচ্ছে শীতলপাটি। মুর্তা নামক এক ধরনের বেতি বা পাতি দিয়ে শীতলপাটি বোনা হয়। সিলেটের বালাগঞ্জ, রাজনগর, বরিশালের স্বরূপকাঠি, ফরিদপুরের সাতৈর, নোয়াখালীর সোনাগাজী, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা প্রভৃতি স্থানে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হয়। আজকাল মানিব্যাগ, হাতব্যাগ, কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ, টেলিম্যাট প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত হয় শীতলপাটি।
মৃৎশিল্প : বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে মৃৎশিল্প। এ শিল্পের হাজার বছরের ইতিহাসও রয়েছে। এ শিল্পকে ঘিরে গ্রামবাংলার অনেক পরিবার জীবন-জীবিকাও নির্বাহ করে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, দিনাজপুর, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলার মৃৎ শিল্পীরা ঐতিহ্যগতভাবে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আসছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী মৃত শিল্পসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে হাঁড়িপাতিল, কলসি, সানকি, চুলা, শাক-সবজি, ফলমূল, খেলনা, পুতুল, ঘরের টালি, পানি সেচের নালি, ধর্মীয় প্রতিকৃতি, প্রাণীজ প্রতিকৃতি, অলঙ্কার প্রভৃতি। গ্রামীণ হাটবাজার এবং শহর-বন্দরেও মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যায়।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

শীতকালে শিশুদের প্রয়োজনীয় যত্ম টিপস ও টোটকা

জেম্মা চ্যান তার শীর্ষ স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট শেয়ার করে, যার মধ্যে রয়েছে $ 10 'সিক্রেট ওয়েপন' আই ক্রিম

Samsung Galaxy Buds 2 পর্যালোচনা